গত রবিবার ভোরে মার্কিন সেনাবাহিনীর বি২ স্পিরিট বোমারু বিমান ইরানের তিন তিনটি পরমাণু কেন্দ্রের উপর হামলা করে। ‘ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর’ বা ‘বাঙ্কার বাস্টার’ ব্যবহার করে ‘ধ্বংস’ করে দেওয়া হয় ফোরডো সহ ইরানের আরো দুটি পরমাণু ঘাঁটি। এই ঘটনার পরেই ইরানের পার্লামেন্ট হরমুজ প্রণালী (Strait of Hormuz) বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। ইরানের সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম ‘প্রেস টিভি’ এই খবর প্রকাশ করেছে। ইরান যদি সত্যিই ‘হরমুজ প্রণালী’ বন্ধ করে, তাহলে তার প্রভাব কাঁপিয়ে ছাড়বে বিশ্ব অর্থনীতিকে। কারণ, বিশ্বের প্রায় এক পঞ্চমাংশ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ হয় এই প্রণালীর মধ্যে দিয়েই। ফলে বিশ্বজুড়ে হু হু করে বাড়তে পারে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম। টান পড়তে পারে আপামর চাহিদায়। সেই অভিঘাতে বাদ যাবে না ভারতও।
একদিকে পারস্য উপসাগর এবং অন্যদিকে আরব সাগর ও ওমান উপসাগরকে সঙ্গে যুক্ত করেছে হরমুজ প্রণালী। এই প্রণালীর একপাশে ইরান এবং অন্যপাশে ওমান। চওড়ায় সংকীর্ণ হলেও (মাত্র ৩৩ কিলোমিটার), বিশ্ব তেলের বাজারে এই সমুদ্রপথের গুরুত্ব অপরিসীম। গোটা বিশ্বের শীর্ষ সামুদ্রিক বাণিজ্য পথগুলির মধ্যে একটি হল হরমুজ প্রণালী। প্রতিদিন সংকীর্ণ এই পথ দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বন্দরে প্রায় ২ কোটি ব্যারেল পরিশোধিত-অপরিশোধিত তেল এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানি হয়। ভারতের তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ আমদানি হয় হরমুজ প্রণালীর মধ্যে দিয়ে। ইরাক, ইরান, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর মত জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী ও ওপেক সদস্যভুক্ত দেশগুলি এই প্রণালীর মাধ্যমেই তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করে। যার মধ্যে বেশিরভাগ অংশই যায় এশিয়ার বাজারে।
এহেন গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক বন্ধের হুঁশিয়ারি যে বিশ্ববাজারে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে তা বলা বাহুল্য। বিশ্বজুড়ে তেলের সরবরাহে আকস্মিক যদি ঘাটতি তৈরি হয় হবে তার প্রভাব হয়ে উঠতে পারে মারাত্মক। তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে পারে অন্যান্য পণ্যের দাম। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরান যদি এই পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে তা আখেরে ইরানের বিপক্ষেই যাবে। কারণ, তেল রপ্তানিকারক দেশ হিসাবে ইরানের তেলও এই হরমুজ প্রণালী দিয়েই বিশ্ববাজারে পৌঁছায়। শুধু ইরান নয়, উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য তেল-নির্ভর দেশগুলোর ক্ষেত্রেও হরমুজ প্রণালী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার আবহে ওই রাষ্ট্রগুলির অনেকেই ইরানের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও, হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দিলে সমস্যায় পড়বে সকলেই। এমন অবস্থায় তারা নিজেদের স্বার্থে যে ইরানের পক্ষ থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করবে না এমনটাও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। অন্যদিকে, হরমুজ প্রণালী অবরুদ্ধ হলে সমস্যায় পড়বে চিনও। কারণ, ইরানের উৎপাদিত তেলের ৯০ শতাংশ যায় চিনে। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মার্কো রুবিও হরমুজ প্রণালী যাতে ইরান বন্ধ না করে তার জন্য বেজিংয়ের হস্তক্ষেপও চেয়েছে।
তবে ইরান-ইজরায়েল সংঘর্ষের পরিস্থিতিতে ভারতের উপর প্রভাব তেমনভাবে পড়বে না বলে দাবি করেছে নয়াদিল্লি। কারণ, বর্তমানে দেশের আমদানীকৃত তেলের একটা বড় অংশ হরমুজ প্রণালী দিয়ে আসে না। রবিবার কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরী বিবৃতি দিয়ে এমনটাই বলেন। এছাড়া তার বক্তব্য অনুযায়ী, ভারতীয় তেল কোম্পানিগুলির কাছে বেশ কয়েক সপ্তাহের জ্বালানি মজুত আছে, যাতে সাধারণ মানুষের জ্বালানি পেতে অসুবিধা না হয়। তবে, অস্বীকার করার কোনো অবসর নেই যে, ইরানের হরমুজ প্রণালী বন্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে তার আঘাত হবে সুদূরপ্রসারী।