Yangtze River China
পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলছে এক নদী। এই নদীর ডাক নাম হল ‘লাল জলের নদী’ বা লাল নদী। নাম লাল হলেও নদীর জল কিন্তু মোটেই লাল নয়। বছরের পর বছর ধরে ক্ষয়কার্যের ফলে নদীখাতে জমে উঠেছে লাল পলি। আর সেই কারণেই নিম্নপ্রবাহের রঙ দেখায় লাল। তবে এই নদীর ভালো নামও আছে- চিশুই হে।
এই চিশুই নদী বা লাল নদী হল ইয়াংসি নদীর একটি উপনদী। চীনের ইউনান প্রদেশ থেকে উৎপন্ন হয়ে এই লাল নদী গুইঝো এবং সিচুয়ান প্রদেশের মধ্যে দিয়ে সর্পিলাকার পথ দিয়ে বয়ে গেছে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। দীর্ঘ এই যাত্রাপথে এই নদীর উপর এতদিন বহাল ছিল প্রায় ৩৫৭ টি বাঁধ এবং ৩৭৩ টি ছোট জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। কিন্তু সেগুলির বেশিরভাগই এখন আর নেই। কারণ, ৩৫৭ টির মধ্যে ৩০০টি বাঁধ ইতিমধ্যে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ৩৪২টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। কিন্তু এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ কি ছিল?
জীব-বিশেষজ্ঞরা লাল নদীকে ইয়াংসি নদীর উপরের অংশে স্থানীয় এবং বিরল প্রজাতির কিছু মাছের শেষ আশ্রয়স্থল হিসাবে মনে করেন। কিন্তু লাল নদীর উপরে এতগুলো বাঁধ এবং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকায় স্বাভাবিকভাবে নদীর জলপ্রবাহ কমে যাচ্ছিল। শুকিয়ে চর বেরিয়ে আসছিল নদীর বেশ কিছু অংশে। যার প্রভাব একেবারে সরাসরি গিয়ে পড়ছিল এইসব বিরল প্রজাতির মাছেদের জীবনচক্রে। নদীর জল ক্রমশ শুকিয়ে যাওয়ায় সংকীর্ণ হয়ে আসছিল মাছেদের আবাসস্থল এবং প্রজননের জায়গা।
চীনের লাল নদীতে বিরল প্রজাতির মাছেদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ইয়াংসি স্টার্জন মাছ। এই স্টার্জন মাছ হল হাড়যুক্ত মাছেদের একটি প্রাচীন বংশ। এদের ‘জীবন্ত জীবাশ্ম’ হিসাবেও মনে করা হয়। কারণ আদিম ডাইনোসরদের সাথে এদের পূর্বপুরুষদের দেখা গিয়েছিল। চীনা প্যাডলফিসের সঙ্গে স্বাদু জলের এই স্টার্জন মাছ ইয়াংসি নদীর শেষ দৈত্য বলেও পরিচিত। ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়ন স্টার্জন মাছকে বিলুপ্ত বলে ঘোষণা করে।

১৯৭০ সালের পর ইয়াংসি স্টার্জনদের সংখ্যা নদীতে দ্রুত হারে কমতে থাকে। এর মূল কারণ ছিল নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ, জাহাজ চলাচল এবং দূষণ। ২০০০ সালের পর প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো আর কোনও নতুন স্টার্জন এখানে দেখা যায়নি। এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে, ইয়াংসি নদীর জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনার জন্য ২০২০ সালে ব্যাপক সংরক্ষণ ও সংশোধন প্রকল্প শুরু করা হয়। তারপর থেকেই আবার ইয়াংসি নদীর জলজ প্রাণীরা তাদের হারিয়ে যাওয়া বাসস্থল এবং প্রাণশক্তি ফিরে পেতে শুরু করে। বলা বাহুল্য, এই প্রকল্পের অংশ হিসাবেই সম্প্রতি ভেঙ্গে ফেলা হল বাঁধ এবং বন্ধ করে দেওয়া হল বেশিরভাগ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
আরও পড়ুন – ‘ধন্বন্তরি’ উটের চোখের জল! এক ফোঁটায় কাটবে ২৬টি সাপের বিষ, দাবি ভারতীয় বিজ্ঞানীদের
উহান ইনস্টিটিউটের এর গবেষকরা ২০২৩ ও ২০২৪ সালে লাল নদীতে স্টার্জনের দুটি দল ছেড়ে দেন। দেখা যায় যে এই মাছগুলো বন্য পরিবেশে বেড়ে ওঠার সঙ্গে টিকে থাকতে শিখেছে। ২০২৫ সালে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য আরও একধাপ এগিয়ে যান গবেষকরা। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় প্রাকৃতিকভাবে প্রজননের জন্য মাছগুলিকে স্থানান্তরিত করা যায় কিনা। সেই উদ্দেশ্যে এপ্রিল মাসে গুইঝো নদীর একটি অংশে ২০টি প্রাপ্তবয়স্ক ইয়াংসি স্টার্জন মাছ ছেড়ে দেওয়া হয়। কিছুদিন পর গবেষকরা খেয়াল করেন মাছগুলির মধ্যে ডিম ছাড়ার আচরণ প্রকাশ পাচ্ছে এবং ডিম থেকে পোনাও বের হচ্ছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রেড রিভার বা লাল নদীর জলজ প্রাণীবৈচিত্র্য উন্নতির পথে। মাছের প্রজাতির সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ইয়াংসি নদীকে জলজ প্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে তুলতে চীন মাছ ধরার উপর ১০ বছরের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। নদী থেকে বালি তোলা বন্ধ সহ একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
তথ্য সুত্র- South China Morning Post