বিশ্বের বিনোদন রাজধানী
মরুভূমির বুকে কৃত্রিম আলোয় মোড়া এই শহর। যেখানে রাত মানেই শুধু উৎসব আর চোখ ধাঁধানো আলোর খেলা। সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথেই শুরু হয় হরেক রকমের আয়োজন। বিনোদনের পসার সাজিয়ে বসে পড়ে হাজারো মানুষ। নৈশপ্রমোদের যতরকম উপকরণ হয় সবই আয়োজন করা হয় এখানে। তারপর চলে সারারাত ধরে আমদপ্রমোদ। সেই কারণে এই শহরকে ‘বিশ্বের বিনোদন রাজধানী’ বলেও ডাকা হয়।
আলোর শহর হিসেবে পরিচিত এই শহরের রাতের রূপ অবর্ণনীয়। রাতে এই শহরে পা রাখলে মনে হয় যেন সিনেমার সেট ধরে হাঁটছি। চারধারে সুবিশাল আলোকোজ্জ্বল বিলবোর্ড, সিজার প্যালেসের রোমান স্তম্ভ, ছদ্ম আইফেল টাওয়ার, আর তার মধ্যে অগণিত মানুষের মাতামাতি। অপরুপ সৌন্দর্যে সাজানো এ শহরের ঘুম নেই। নেই কোনো বিশ্রাম। বিনোদন জগতের বিস্ময় এই শহর তাই গোটা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে স্বপ্নের শহর।
আমেরিকার মোজাভে মরুভূমি অঞ্চলে অবস্থিত এই শহরের নাম লাস ভেগাস (Las Vegas)। যা বিনোদন জগতের বিস্ময়। মরুভূমির মধ্যে অবস্থিত হওয়ায় এই শহরের প্রকৃতি শুষ্ক ও তপ্ত। গরমের মাসগুলোতে এখানে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। তবে শীতকাল থাকে আরামদায়ক এবং শুষ্ক। যদিও আবহাওয়ার এই কঠোরতা শহরের রঙিন জীবনধারার উপর মোটেও প্রভাব ফেলতে পারেনি। কারণ, এই শহরের প্রাণ লুকিয়ে আছে তার কৃত্রিম ঝলমলে রাতের জগতে।

তবে, এই শহর আগে থেকে এমনটা ছিল না। ছিল জনশূন্য, রুক্ষ একটি মরু অঞ্চল। ১৯০৫ সালে শহরে রেলপথে গড়ে ওঠার মাধ্যমেই এই শহরের গোড়াপত্তন হয়। এই রেলপথ লাস ভেগাস শহরের মধ্যে দিয়ে লস অ্যাঞ্জেলস এবং সল্টলেক শহরকে জুড়ে দিয়েছিল। তারপর থেকেই এখানে বসতি স্থাপন হতে শুরু করে।
১৯১১ সালে শহরের উপকণ্ঠ দিয়ে বয়ে চলা কলোরাডো নদীর উপর হুভার বাঁধ তৈরির কাজ শুরু হয়। বাঁধ তৈরির কাজে অসংখ্য মানুষের লাস ভেগাসে আসতে শুরু করে। কাজের খোঁজে বাড়তে থাকে যুবক শ্রমিকদের ভিড়। আর সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে প্রশস্ত হতে থাকে নগরায়নের পথ। দ্রুত নগরায়নের সুযোগ নিয়ে এই সময় মাফিয়ারা লাস ভেগাসে তাদের টাকা ঢালতে শুরু করে। কমবয়সী যুবক শ্রমিকদের বিনোদন আর বিলাসিতার প্রলোভন দেখিয়ে গজিয়ে উঠতে থাকে একের পর এক ক্যাসিনো, হোটেল আর থিয়েটার। সেই শুরু। বাঁধ তৈরির কাজ শেষ হলে এই শহর পরিপূর্ণতা পায়। ততদিনে অবশ্য লাস ভেগাস হয়ে উঠেছিল অসংখ্য বিলাসবহুল হোটেলের কেন্দ্রস্থল।

ওই বছরই (১৯১১ সাল) লাস ভেগাস শহরের স্বীকৃত পায়। তবে লাস ভেগাসের আসল রূপান্তর ঘটে ১৯৩১ সালে, যখন নেভাদা রাজ্যে ক্যাসিনো জুয়া খেলা আইনি বৈধতা পায়। যদিও তার পটভূমি তৈরি হয়ে গিয়েছিল আগেই। এই আইনই লাস ভেগাসকে পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় ক্যাসিনো ও বিনোদন নগরীতে রূপান্তরিত করেছিল। পর্যটনের নিরিখেও এই শহর বিশ্বের শীর্ষ শহরগুলির মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিল অচিরেই।
এই শহরের মূল আকর্ষণ হল লাস ভেগাস স্ট্রিপ। প্রায় ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রাস্তার দুপাশ জুড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য হোটেল, ক্যাসিনো, থিয়েটার আর দোকানপাট। এমজিএম গ্র্যান্ড, বেলাগিও, সিজার্স প্যালেস, দ্য ভেনেসিয়ান এবং লুক্সর-এর মত অসংখ্য বিলাসবহুল হোটেলগুলো এই রাস্তার দুপাশেই গড়ে উঠেছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এইসব হোটেলগুলোতে বাড়তে থাকে ক্যাসিনো, কেনাকাটা এবং সীমাহীন বিলাসিতার আয়োজন। এখানকার প্রতিটি হোটেল যেন একেকটা দেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে ধরে তৈরি হয়েছে। কোনোটা মিশরের পিরামিডের অনুকরণে, কোনোটা আবার রোমান সাম্রাজ্যের ভাবনায়।
Golden hour at the Palace pic.twitter.com/qJ1jMM3wbo
— Caesars Palace (@CaesarsPalace) June 23, 2025
লাস ভেগাসের জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ। রাতের নগরীর একটুকরো স্বাদ পেতে বছরভর বহু পর্যটক এখানে ভিড় জমায়। জুয়া খেলার দৌলতে কেউ কেউ আবার চলে আসে এক রাতে নিজের ভাগ্য ফেরাতে। জুয়া, পতিতাবৃত্তি, কালবাজারি আর মাফিয়ারাজের জন্য এই শহরকে অনেকে ‘পাপের শহর’ও বলে। এতদসত্বেও, লাস ভেগাস পর্যটকদের কাছে এক অনন্য অনুভূতি। এক স্বপ্নের শহর। তাই একসময়কার জনশূন্য মরু অঞ্চল লাস ভেগাস এখন লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে নতুন অভিজ্ঞতার প্রতিশ্রুতি।