ব্ল্যাক ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল: একসময় কালো রঙে ঢাকা হয়েছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ইতিহাসের পাতায় সে অধ্যায় আজও অমলিন।
১, কুইন্স ওয়ে, ময়দান, কলকাতা। জায়গাটির সম্বন্ধে পরিচিতি থাকলেও, এই ঠিকানার সঙ্গে পরিচিতি কিন্তু অনেকেরই নেই। মেট্রো থেকে বেরিয়ে, ময়দানের গা ঘেঁষে বেশ কয়েক পা হাঁটলেই চোখে পড়বে এই জায়গা। ব্রিটিশ আমলের তৈরি শ্বেতশুভ্র ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধ। আমাদের কাছে যা ঐতিহাসিক ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।
কলকাতা শহরের বুকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ফেলে আসা সময়ের পদচিহ্ন। ১৯২১ সালে মহারানী ভিক্টোরিয়ার স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল এই স্মৃতিসৌধ। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন। গম্বুজওয়ালা স্মৃতিসৌধের ওপরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ব্রোঞ্জের ‘উড়ন্ত পরি’।
ইন্দো সারসেনিক শৈলীর সঙ্গে মুঘল স্থাপত্যের উপাদান জুড়ে তৈরি করা হয়েছিল এই ইমারত। সারা বছর জুড়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে দেখতে পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে। সকাল-সন্ধ্যে সেলফি তোলার হিড়িকে সাদা মার্বেলের এই প্রাসাদ জীবন্ত হয়ে ওঠে। প্রেমিক-প্রেমিকা থেকে শুরু করে বাচ্চা-বুড়ো- সকলেরই আকর্ষণের কেন্দ্র এই স্মৃতিসৌধ।

কিন্তু জানেন কি, এক সময় এই শ্বেতশুভ্র ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে ঢেকে ফেলা হয়েছিল কালো রঙে? শুধু ঢেকে দেওয়াই নয়, ভবনের চারপাশে চলত কড়া নজরদারি। এমনকি, ছবি তোলাও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
সময়টা ১৯৪৩ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। জাপান, জার্মানি আর ইতালির অক্ষশক্তির বিপক্ষে লড়াই করছে ব্রিটেন, আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চিনের মিত্রশক্তি। ভারত তখনও পরাধীন। তবে সদ্য ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ধাক্কায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গদি তখন টালমাটাল অবস্থা। স্বাধীনতার দিন গুনতে শুরু করেছে প্রত্যেক ভারতবাসী। সারা দেশ জুড়ে ব্রিটিশ হটাও রব।
ভারত সরাসরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও এই শহর কলকাতা তখনও ব্রিটিশদের শক্ত ঘাঁটি। এর মধ্যে জাপান আকাশপথে কলকাতার ওপর বোমাবর্ষণ শুরু করল। প্রথমে আন্দামান, তারপর উত্তর-পূর্বাঞ্চল হয়ে লক্ষ্য স্থির হয় কলকাতায়। শহরের আকাশে ভেসে বেড়াতে শুরু করল অক্ষশক্তির বোমারু বিমান। তখন শহরে হামলার জন্য রাতকেই বেছে নিত জাপানের বিমানগুলি।

রাতের অন্ধকারে ভয়ংকর জাপানি হামলা থেকে বাঁচতে উপায় খুঁজতে শুরু করল কলকাতার মানুষ। নেওয়া হল অভিনব এক উদ্যোগ। রাতের অন্ধকারে বাড়িঘর, দোকান-পাট, উঁচু নির্মাণ যাতে জাপানি বায়ুসেনার নজরে না আসে, তার জন্য কালো কাপড় বা কাগজ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল সব কিছু।
এই ঘটনায় ব্রিটিশরাজের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। ভেবে কুল পাওয়া যাচ্ছিল না যে কিভাবে রক্ষা পাবে শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যগুলো। শ্বেতপাথরের তৈরি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দূর-দুরান্ত থেকেও রাতের অন্ধকারেও চকচক করত। পূর্ণিমার আলোয় তার রূপ হয়ে উঠত আরো উজ্জ্বল। তাই সহজেই জাপানি বোমারু বিমানের টার্গেট হতে পারত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।
অন্ধকারে জাপানি গোলাবর্ষণ থেকে বাঁচাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল ব্রিটিশ এই ইমারতকে ঢেকে ফেলা হবে কালো প্রলেপ দিয়ে।
যেমন সিদ্ধান্ত তেমন কাজ। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের চারপাশে বিশাল বাঁশের কাঠামো তৈরি হল। তার পর মাটি, গোবর ও ছাই মিশিয়ে তৈরি করা হল এক বিশেষ ধরনের প্রলেপ। সেই কালো মিশ্রণে ঢেকে ফেলা হয় পুরো স্মৃতিসৌধ।

উদ্দেশ্য ছিল, ভবনটিকে রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য করে ফেলা। যাতে জাপানি বোমারু বিমান চালকরা সাদা মার্বেলের এই ইমারৎকে সহজে দেখতে না পায়। এছাড়া, আশেপাশের এলাকা করে দেওয়া হয়েছিল আলোবাতি শূন্য। চালু হয় ব্ল্যাকআউট।
নিষিদ্ধ করা হয় ফোটোগ্রাফিও। যাতে শত্রুপক্ষের কাছে এই এই পরিকল্পনা ফাঁস না হয়ে যায়।
পরে যুদ্ধের ভয় কেটে গেলে তুলে ফেলা হয় কালো প্রলেপ। আবার আগের রূপে ফিরে আসে এই স্মৃতিসৌধ।
আজকের প্রজন্মের কাছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হয়ত নিছকই এক পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় স্থাপত্যের এই ঐতিহাসিক নিদর্শন একবার সত্যিই ‘কালো’ হয়ে গিয়েছিল যুদ্ধের কারণে। ইতিহাসের পাতায় সেই অধ্যায় আজও গোছানো আছে সযত্নে।