বিজয়া দশমী ২০২৫
আজ বিজয়া দশমী। শারদীয়া দুর্গোৎসবের অন্তিম দিন। ঘরের মেয়ে উমার এবার কৈলাসে ফেরার পালা। পঞ্চমী থেকে শুরু করে ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী- এই পাঁচ দিন হৈ-হুল্লোড় করে কাটানোর পর আজ মন ভার আপামর বাঙালির। পুজো প্যান্ডেলে তাই আজ সকাল থেকেই শুরু হয়েছে মা-কে বিদায় জানানোর প্রস্তুতি। তবে এই বিজয়া দশমীর দিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একাধিক রীতি রেওয়াজ। দেবী দুর্গার বরণ ও সিঁদুর খেলা তার মধ্যে অন্যতম।
বিজয়া দশমীতে দেবী বরণ
শাস্ত্র অনুসারে বিজয়া দশমীর দিন দেবীকে বিদায় জানানোর আগে দেবীকে বরণ করে নেওয়া হয়। বিসর্জনের আগে ঘরের মেয়েকে বিদায় জানাতে পরিবারের সবাই সামিল হন। বিশেষভাবে সাজানো হয় বরণডালা। তাতে নিয়ম মেনে রাখা হয় সিঁদুর, সুপারি, দুটি পানপাতা, ফুল, দূর্বা, চাল, মিষ্টি, ধূপকাঠি, প্রদীপ, জল, পানের খিলি আর ষোলো আনা বা একটাকার কয়েন। বরণডালার প্রতিটি উপকরণের মধ্যে থাকে প্রতীকী অর্থ। যেমন সিঁদুর মানে সৌভাগ্য, দূর্বা মানে দীর্ঘায়ু, পান ও সুপারি মানে সমৃদ্ধি ও পূর্ণতা।
বরণ করার আগে স্নান করে শুদ্ধবসনে আলতা সিঁদুর পরে তবেই মা-কে বরণ করাই রীতি। বরণের প্রথমে মায়ের সিঁথি ও বাম হাতের শাখায় সিঁদুর পরিয়ে দেওয়া হয়। দেবী দুর্গা গৃহিণীর রূপেই মর্ত্যে পূজিতা হন, তাই তাঁর সিঁথি ও শাখায় সিঁদুর পরিয়ে সংসার ও পরিবারের কল্যাণ কামনা করা হয়। এরপর পরিষ্কার পানপাতা দিয়ে দেবীর মুখ মোছা হয়। তারপর মাতৃজ্ঞানে দেবীর পায়ে ধান-দূর্বা দেওয়া হয়। কন্যাজ্ঞানে পরে দেবীর মাথায় ধান-দূর্বা দেওয়া যায়।
এরপর মায়ের মিষ্টিমুখ এবং জলপান করানোর অধ্যায়। মায়ের মুখে একে একে সামান্য মিষ্টি-জল তুলে দেওয়া হয়। ডালার পানের খিলিটা তুলে দেওয়া হয় মায়ের হাতে। আচার শেষ হলে দেবীর কাছ থেকে পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হয়।
ঠিক এভাবে নিয়ম মেনে লক্ষ্মী, গণেশ, সরস্বতী এবং কার্তিককে বরণ করা হয়। বাদ যায় না দেব-দেবীদের বাহনরাও। দেবী দুর্গার বিসর্জন হয়ে যাওয়ার তিনদিন পর বরণডালার পানদুটি জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তারপর ধুয়ে নেওয়া হয় ডালাটি।

সিঁদুর খেলা
বিজয়া দশমীতে দেবীবরণ শেষে আসে সিঁদুর খেলার পর্ব। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার বধূরা দশমীর দিন সকালে দেবী বরণের পর একে অপরকে সিঁদুর পরিয়ে দেন। দুর্গা পুজোর সঙ্গে সিঁদুর খেলার কোনো সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দীর্ঘদিনের সামাজিক আচার। শাস্ত্র মতে, সিঁদুর হল সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির প্রতীক। পুরাণে সিঁদুরকে পরম ব্রহ্মের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী বিবাহিত নারীর কপালে সিঁদুর যেমন একদিকে সংসারে সুখ ও সমৃদ্ধি বয়ে নিয়ে আসে, তেমনি স্বামীর কল্যাণসাধনও করে। বিজয়া দশমীর তিথিতে স্বামীর কল্যাণ ও দীর্ঘায়ু কামনা করেই বাংলার বধুরা সিঁদুর খেলা করেন।
দেবী দুর্গা কেবল শক্তিরুপী দুর্গতিনাশিনী নন, তিনি ঘরের মেয়ে। দেবীর স্বামীগৃহে ফিরে যাওয়ার আগে সংসারের কল্যানার্থে তাই তাঁকে সিঁদুর পরিয়ে মিষ্টি মুখে বিদায় জানানো হয়। আর বাংলার বধুরা মায়ের বিদায়ী বেলায় সেই বিশ্বাস থেকেই মেতে ওঠেন সিঁদুর খেলায়। লাল সিঁদুরে মুখমণ্ডল রাঙিয়ে নারীরা একে অপরকে শুভেচ্ছা জানান।
বরণ ও সিঁদুর খেলার পর দেবীকে প্রণাম জানিয়ে শুরু হয় বিসর্জনের পালা। নদী বা জলাশয়ে প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে মায়ের কৈলাস যাত্রা সম্পূর্ণ করা হয়। শেষ হয় বিজয়া দশমীর পর্ব। তবে বিদায়ের মধ্যেও বাঙালির হৃদয়ে নতুন করে শুরু হয় আগামী বছরের জন্য অপেক্ষা। ‘মা তুমি আবার এসো’।