Thursday, November 27

বিনোদন

ধর্মেন্দ্র: এক অবিসংবাদিত কিংবদন্তির জীবনাবসান

যে মানুষটি গ্রামের অলি-গলির ধুলো মেখে স্বপ্ন দেখতে শিখেছিলেন, তিনিই পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিলেন হিন্দি সিনেমার অবিসংবাদিত কিংবদন্তি।
ধর্মেন্দ্র: এক অবিসংবাদিত কিংবদন্তির জীবনাবসান
নক্ষত্রপতন। ধর্মেন্দ্রর জীবনাবসান। ছবি- এক্স।

ধর্মেন্দ্র: এক অবিসংবাদিত কিংবদন্তির জীবনাবসান

ভারতীয় চলচ্চিত্রের বিস্তৃত আকাশে বহু নক্ষত্রের আনাগোনা হয়েছে। ধর্মেন্দ্র তেমনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম, যার আলো যুগ পেরিয়েও অমলিন হয়ে আছে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে। তিনি বলিউডের ‘হি–ম্যান’, রোম্যান্টিক-অ্যাকশন নায়ক, ধর্ম সিং দেওল। ব্যক্তিত্ব, অভিনয় আর জীবনসংগ্রামের বলে তিনি জয় করেছিলেন অসমুদ্রহিমাচল দর্শকের মন। পর্দায় যে কোনও চরিত্রকে স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিমায় জীবন্ত করে তুলতে পারতেন তিনি। যে মানুষটি গ্রামের অলি-গলির ধুলো মেখে স্বপ্ন দেখতে শিখেছিলেন, তিনিই পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিলেন হিন্দি সিনেমার অবিসংবাদিত কিংবদন্তি। পিটিআই সূত্র অনুসারে, আজ, ২৪ নভেম্বর, সোমবার সকালে সেই কিংবদন্তি অভিনেতা চিরবিদায় নিলেন। তাঁর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ তাঁর পরিবারসহ গোটা চলচ্চিত্রজগৎ। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯।

দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন ধর্মেন্দ্র। চলতি মাসের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায় তাঁকে বেশ কিছুদিন আগে
মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেসময়, তাঁর মৃত্যুর খবর নিয়ে ভুয়ো সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল। এ নিয়ে বিস্তর সমালোচনাও করা হয় তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে। পরিবার সূত্রে জানানো হয়, তিনি সুস্থ আছেন, স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। ২৪ নভেম্বর, সোমবার ছয় সন্তান আর দুই স্ত্রীকে রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে গোটা বলিউডে। তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে শোকজ্ঞাপন করেছেন বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যাক্তি থেকে অভিনেতা অভিনেত্রীরা।

ধর্মেন্দ্রর মৃত্যুতে কমল হাসানের শোকজ্ঞাপন-

ধর্মেন্দ্রর প্রয়াণে শত্রুঘ্ন সিনহার সমবেদনা-

১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত পাঞ্জাবের লুধিয়ানার এক সাধারণ পরিবারে জন্মেছিলেন ধর্ম সিং দেওল, ওরফে ধর্মেন্দ্র। ছোটবেলা থেকেই সিনেমা ছিল তাঁর নেশা। সেই নেশাই তাঁকে ১৯৫৮ সালের ফিল্মফেয়ার ট্যালেন্ট হান্ট–এ এনে দেয় প্রথম বড় সুযোগ। ১৯৬০ সালে ‘দিল ভি তেরা হাম ভি তেরে’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে শুরু হয় বলিউডে তাঁর অভিনয়জীবনে। তবে সংগ্রামের পথ সহজ ছিল না। কিন্তু পর্দায় তাঁর স্বভাবসিদ্ধ উপস্থিতি, দৃঢ় কণ্ঠ আর সহজাত অভিনয় অচিরেই তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে।

ষাট, সত্তর ও আশির দশক জুড়ে পর্দায় তিনি জাদু ছড়িয়েছিলেন। রোম্যান্টিক ছবি থেকে শুরু করে অ্যাকশন, কমেডি বা পারিবারিক নাটক, সবেতেই তিনি ছিলেন সমান স্বচ্ছন্দ। আনপড়, বন্দিনী, ধর্মবীর, রাম বলরাম, চুপকে চুপকে, ফুল অউর পাত্থর, রেশম কি দোরি, শোলে- প্রত্যেকটি ছবিতেই তিনি ফেলে রেখেছেন স্বতন্ত্র অভিনয়ের ছাপ। বিশেষ করে শোলে ছবিতে তাঁর সংলাপ- “বাসন্তী, ইন কুত্তো কে সামনে মট নচনা” আজও জনপ্রিয়তার শিখরে। অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা এবং তারকাসত্তার সহবস্থান তাঁকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। দীর্ঘ ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে ধর্মেন্দ্র অভিনয় করেছেন প্রায় ৩০০টিরও বেশি ছবিতে।

চলচ্চিত্রের মতোই আলোচিত ছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। চলচ্চিত্র জগতে পা দেওয়ার আগেই ১৯৫৪ সালে তিনি বিয়ে করেন প্রকাশ কৌরকে। চার সন্তান হয় তাঁদের- সানি, ববি, অজিতা এবং বিজেতা। সানি দেওল এবং ববি দেওল দু’জনেই বলিউডের সফল অভিনেতা। পরে মুম্বইতে এসে হেমা মালিনির সঙ্গে পরিচয় ও প্রেম হয়। সিনেমায় হেমার সঙ্গে তখন তাঁর মাখোমাখো সম্পর্ক। পরে হেমাকেই বিয়ে করেন তিনি। এই বিয়ে নিয়ে বলিউডে তখন কম চর্চা হয়নি। ধর্মেন্দ্র হেমার দুই কন্যা সন্তানও হয়। এষা এবং অহনা দেওল। হেমা মালিনির সঙ্গে বিয়ে হলেও প্রকাশ কৌর-এর সঙ্গে কোনোদিনই তাঁর আইনি বিচ্ছেদ হয়নি। দুই স্ত্রীর সঙ্গেই আজীবন নিজেকে সুতোয় বেঁধে রেখেছিলেন। কিন্তু বাস্তব জীবনে তাঁরা ছিলেন পরস্পরের অবলম্বন।

জীবনের শেষ বয়স পর্যন্ত কাজের প্রতি ধর্মেন্দ্রর আগ্রহ অটুট ছিল। সম্প্রতি ‘রকি অউর রানি কি প্রেম কাহানি’ ছবিতে তাঁকে দেখতে পেয়েছিল দর্শকরা। তাঁর অভিনয় জীবনের শেষ পর্দা প্রদর্শন হবে ‘ইক্কিস’ ছবির মাধ্যমে। আগামী ২৫ ডিসেম্বর মুক্তি পাবে শ্রীরাম রাঘবন পরিচালিত ছবিটি।

অভিনয়ে কৃতিত্ব হিসাবে ধর্মেন্দ্র তাঁর মর্যাদা পেয়েছেন। ফিল্মফেয়ার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৭), পদ্মভূষণ (২০১২) সহ অসংখ্য সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। কিন্তু পুরস্কার আর চোখ ধাঁধানো কর্মজীবনের বাইরেও ধর্মেন্দ্র ছিলেন একজন অত্যন্ত সাধারন মানুষ। জীবনের চলার পথকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন নিজের ছন্দে।

আজ তাঁর প্রয়াণে চলচিত্র জগতের একটি যুগের ইতি ঘটল। কিন্তু তিনি রেখে গেলেন এমন এক উত্তরাধিকার, যা ভারতীয় চলচ্চিত্রের পর্দায়, স্মৃতিতে, আর লক্ষ-লক্ষ দর্শকের হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবে। ধর্মেন্দ্র শুধু একজন অভিনেতা নন, ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে একটি দীর্ঘস্থায়ী স্মরণীয় অধ্যায়। এক কিংবদন্তি।

ফলো করুণ-