ধুরন্ধর ছবির কাল্পনিক চরিত্র বনাম ‘বাস্তব’ চরিত্র
আদিত্য ধর পরিচালিত ‘ধুরন্ধর’ মুক্তি পাচ্ছে আগামী ৫ ডিসেম্বর। স্পাই থ্রিলার ঘরানার এই ছবির মুক্তি ঘিরে ইতিমধ্যে সরগরম নেটদুনিয়া। ট্রেলারের খন্ড খন্ড দৃশ্যে ভেসে ওঠা নৃশংসতা, হিংসা আর রক্তস্রোতের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে সমাজমাধ্যমে। শুধুমাত্র ভারতে নয়, পাকিস্তানেও এই ছবি এখন আলোচনার কেন্দ্রে। কারণ, কাউন্টার টেরোরিজম নিয়ে নির্মিত এই ছবির চরিত্রগুলোর সঙ্গে নাকি ‘হুবহু’ মিল রয়েছে বাস্তব জীবনের বিভিন্ন গল্পের। কি সেই গল্প? ছবির চরিত্রের সঙ্গে বাস্তবের কোন চরিত্রের মিল রয়েছে? খোঁজ দিল সিবুলেটিন ডট কম।
রণবীর সিং, ‘ঈশ্বরের ক্রোধ’
ধুরন্ধর ছবির মূল চরিত্রে রয়েছেন রণবীর সিং। ৪ মিনিটের ট্রেলারে রণবীর সিংকে দূর্ধর্ষ লুকে দেখা গেলেও, ছবিতে তাঁর নাম কি হবে তা প্রকাশ করা হয়নি। তবে, ট্রেলারে স্পষ্ট যে, তিনি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ দমনের উদ্দেশ্যে একজন আন্ডারকভার ভারতীয় এজেন্ট বা সেনার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ট্রেলারে তাঁকে ‘ঈশ্বরের ক্রোধ’ হিসেবে পরিচয় করানো হয়েছে। তবে নেটদুনিয়ায় এরকমই গুঞ্জন যে, রণবীর সিংয়ের চরিত্রটি অশোকচক্র বিজয়ী মেজর মোহিত শর্মার চরিত্রের অনুপ্রেরণা থেকেই তৈরি হয়েছে।
মেজর মোহিত শর্মা ‘ইফতিখার ভাট’ নামে হিজবুল মুজাহিদিন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে অনুপ্রবেশ করেছিলেন এবং জম্মু ও কাশ্মীরের কুপওয়ারার হাফরুদা জঙ্গলে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে অসীম বীরত্বের পরিচয় দেন। সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে আপোষহীন যুদ্ধে জয় হাসিল করার পর শহীদ হন তিনি। ট্রেলারে রণবীর সিংয়ের অবতার যেন একেবারে সেই মেজর মোহিত শর্মারই প্রতিকৃতি। যদিও, ছবির পরিচালক আদিত্য ধর এই দাবিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন।
অর্জুন রামপাল ‘মেজর ইকবাল’, ‘মৃত্যুদূত’
ট্রেলার শুরুতেই দেখা যায় নৃশংস দৃশ্য। মাছ ধরার বড়শি দিয়ে অকথ্য নির্যাতন করা হচ্ছে একজন ভারতীয় সেনাকে। নির্যাতকের ভূমিকায় অর্জুন রামপাল। ট্রেলারে তিনি ‘মেজর ইকবাল’। যাঁর চোখ আর অভিব্যক্তিতে ঠিকরে বেরোচ্ছে হিংসা আর পাশবিকতা। হিমশীতল কণ্ঠে তিনি আউড়াচ্ছেন প্রাক্তন পাক প্রেসিডেন্ট জিয়া-উল-হকের সহস্র আঘাতে ভারতকে রক্তাক্ত করার কথা।
গুঞ্জন অনুযায়ী, ‘মেজর ইকবাল’-এর চরিত্রটি গভীরভাবে মিল খায় পাকিস্তানের কুখ্যাত জঙ্গিনেতা ইলিয়াস কাশ্মিরির সঙ্গে। যিনি ছিলেন সাক্ষাৎ ‘মৃত্যুদূত’। কার্গিল যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনার হাতে ভারতীয় সেনাদের নির্যাতনের কথা মনে করিয়ে দেয় তার নাম। যাঁকে একসময় ‘নিউ ওসামা বিন লাদেন’ বলেও ডাকা হত। আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধের সময় এই ইলিয়াস কাশ্মিরি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তিনিই পরে আল-কায়েদা ও জইশ-ই-মহম্মদের অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন। ২৬/১১ মুম্বই হামলাতেও তাঁর যোগসূত্রের প্রমাণ মেলে। ২০১১ সালে মার্কিন ড্রোন হামলায় তাঁর মৃত্যু হয় বলে জানা যায়।
আর মাধবন ‘অজয় সান্যাল’, ‘কর্মের সারথি’
ট্রেলারে আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আর মাধবন ‘অজয় সান্যাল’- এর ভূমিকায়। যিনি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পোড়খাওয়া গোয়েন্দা অফিসার। ট্রেলারে তিনি চেন-স্মোকার, কঠোর বাস্তববাদী, এবং পাকিস্তানের সন্ত্রাসী কাঠামোর বিরুদ্ধে ‘প্রতিঘাত’ হানতে সিদ্ধহস্ত।
নেটপন্ডিতদের বুঝতে একটুকুও অসুবিধা হয়নি যে মাধবনের এই চরিত্রটি আগাগোড়া অনুপ্রাণিত হয়েছে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল-এর জীবন থেকে। ঠাণ্ডা মাথায় তাঁর মনোলগ ‘সন্ত্রাসের রন্ধ্রে ঢুকে আঘাত হানার কৌশল’ যেন বাস্তবের সেই চরিত্রেরই ইঙ্গিত বহন করে। ১৯৯৯-এর আইসি-৮১৪ বিমান ছিনতাইয়ে জিম্মিদের মুক্তিতে তাঁর ভূমিকা, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, বালাকোট বিমান হামলা- সব মিলে দোভাল যেন কিংবদন্তি ‘ভারতের জেমস বন্ড।’
‘রেহমান ডাকাইত’-এর চরিত্রে অক্ষয় খান্না, ‘অ্যাপেক্স প্রিডেটর’
ট্রেলারে ‘রেহমান ডাকাইত’কে ‘মেজর ইকবাল’-এর মতনই অত্যন্ত নির্মম একজন বলে দেখানো হয়েছে। তাঁকে পরিচয় করানো হয়েছে ‘অ্যাপেক্স প্রিডেটর’ হিসেবে। কসাইয়ের মত যিনি খুন করেন। নেটনাগরিকদের গুঞ্জন অনুযায়ী, করাচির কুখ্যাত গ্যাং লর্ড আবদুল রেহমান বালুচ এর আদলেই তৈরি করা হয়েছে এই ‘রেহমান ডাকাইত’-এর চরিত্র। পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামোর গভীরে যাঁর শিকড় বিস্তার করেছিল।
বাস্তবে সর্দার আবদুর রেহমান বালুচ, ট্রেলারে রেহমান ডাকাইত, ছিলেন করাচির লিয়ারি অঞ্চলের অবিসংবাদিত ডন। মাদকপাচার, অপহরণ, খুন, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা- সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন পাকিস্তানের আন্ডারওয়ার্ল্ডের অঘোষিত সম্রাট। কিশোর বয়সেই নিজের মাকেও হত্যা করেছিলেন বলে অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। পরে গড়ে তুলেছিলেন ‘পিপলস অ্যামান কমিটি’। রাজনীতির ছত্রছায়ার আড়ালে চলত তাঁর নিজের সাম্রাজ্য। ২০০৯ সালে পাকিস্তান পুলিশের এসপি চৌধুরি আসলাম খানের নেতৃত্বে এক এনকাউন্টারে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল বলে শোনা যায়। কিন্তু বিতর্কিত সেই মৃত্যুকে ঘিরে আজও রয়েছে বিস্তর ধোঁয়াশা। ধুরন্ধরে তাঁর চরিত্র সেই ভয়ঙ্কর আন্ডারওয়ার্ল্ডের গল্পকে রুপোলি পর্দায় তুলে ধরবে বলে ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে।
সঞ্জয় দত্ত , ‘দ্য জিন’
সিনেমা নিয়ে কাটাছেঁড়া করা দর্শকদের মতে, ধুরন্ধর ছবিতে সঞ্জয় দত্তের চরিত্রটি যেন তুলে আনা হয়েছে পাকিস্তানের টপ কপ চৌধরি আসলাম খানের বাস্তব জীবন থেকেই। এমনকি এই দুজনের চেহারাতেও অনেকটাই মিল খুঁজে পেয়েছেন সিনেমাবোদ্ধারা। সত্যিই কি তবে এসপি চৌধুরি আসলামের চরিত্রে এই ছবিতে অভিনয় করেছেন সঞ্জয় দত্ত? নেটনাগরিকরা এমন দাবি করলেও, ছবি মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত কিন্তু সে দাবি প্রমাণিত হওয়ার কোনো উপায় নেই। তবে, কে ছিলেন এই অধিক আলোচিত চৌধুরি আসলাম?
আসলে চৌধুরি আসলাম ওরফে চৌধুরি আসলাম স্বাতি ছিলেন পাক পুলিশের নাম করা পুলিশ অফিসার। ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই চৌধুরি আসলাম মুহাজির কওমি মুভমেন্ট, তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি), বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ), টিএমপি, লস্কর-ই-ঝাংভি (এলজে), লস্কর-ই-তৈয়বা (এলইটি) এবং সিপাহ-ই-সাহাবা পাকিস্তান (এসএসপি) সমর্থিত বহু সন্ত্রাসবাদী, গ্যাংস্টার, টার্গেট কিলার এবং তোলাবাজদের গ্রেফতার ও হত্যা করেছিলেন। করাচির মাফিয়া দমন, লিয়ারি গ্যাং-যুদ্ধ, আরশাদ পাপ্পু থেকে রেহমান ডাকাইতের খতম- সব জায়গায় ছিল তাঁর সমান উপস্থিতি। একাধিক প্রাণঘাতী হামলা থেকে বেঁচে ফিরলেও শেষমেষ এই পুলিশ অফিসারের জীবন শেষ হয়েছিল ২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারি, তালিবানের নৃশংস বোমা হামলায়।
শেষকথা, ধুরন্ধর ছবির কাল্পনিক চরিত্রগুলি বাস্তব চরিত্রের ছাঁচে আদৌ নির্মিত কিনা তা একমাত্র সময়ই বলবে। বাকি সবটাই গুঞ্জন।
তথ্যসূত্র- উইকিপিডিয়া, সমাজমাধ্যম
আরও পড়ুন – ভাইরাল ‘কেউ বলে বিপ্লবী, কেউ বলে ডাকাত’, জিতের আসন্ন ছবির ট্রেলারে টালমাটাল নেটদুনিয়া
আরও পড়ুন – New Bengali Movie List December 2025: বড়দিনে মুক্তি পাচ্ছে একগুচ্ছ বাংলা ছবি, জেনে নিন কি কি


